সদ্যপ্রাপ্ত

দেবীদ্বারে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত দিবস পালিত

এবিএম আতিকুর রহমান বাশার : ৪ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় দেবীদ্বার হানাদার মুক্ত দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে দেবীদ্বার উপজেলা প্রশাসন ও দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব পৃথক আয়োজনে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করেছে। ভোর থেকেই মহন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে উপজেলা প্রশাসন, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব, দৃষ্টান্ত ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দেবীদ্বার মুক্তিযুদ্ধ চত্তর, বধ্যভ‚মিভ‚মি ও দেবীদ্বার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে।
সকাল ১০টায় উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে একটি র‌্যালি উপজেলা সদরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। অপরদিকে সকাল ১১টায় উপজেলা প্রেসক্লাব’র উদ্যোগে প্রেসক্লাব কার্যালয়ে এক আলোচনা সভা করা হয়।
উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র চাকমার সভাপতিত্বে এবং আ’লীগ উপজেলা যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান ভ‚ঞার সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, আ’লীগ উপজেলা সভাপতি আলহাজ্ব জয়নুল আবেদীন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবদুস সামাদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মোঃ রফিকুল ইসলাম, জেলা পরিষদ সদস্য শিরিন সুলতানা, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান সুফিয়া বেগম, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইউনুছ মিয়া প্রমুখ।
অপরদিকে উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে প্রেসক্লাব কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রেসক্লাব সভাপতি সৈয়দ খলিলুর রহমান বাবুল’র সভাপতিত্বে এবং চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ’র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মমিনুর রহমান বুলবুল মাষ্টার’র সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কুমিল্লা জেলা সভাপতি সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবিএম আতিকুর রহমান বাশার, চান্দিনা উপজেলা ন্যাপ সভাপতি বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মো: সুলতান আহমেদ, চট্রগ্রাম জেলা ন্যাপ নেতা বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নবী খান, পৌর ন্যাপ সভাপতি আব্দুল মান্নান মনু মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফু ফকির, যুব ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা সভাপতি একেএম মিজানুর রহমান কাউছার, কৃষক সমিতি উপজেলা নেতা মোঃ শাহ্ আলম মোল্লা, যুবইউনিয়ন নেতা মোঃ শাহজাহান সরকার, আজিজুল হক ডালিম, ছাত্র ইউনিয়ন উপজেলা সভাপতি রাজিব সরকার, সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাংবাদিক এম,এ, হালিম, সাংবাদিক এ,আর, আহমেদ হোসাইন।
আলোচকরা বলেন, ১৯৭১সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে মুক্তিযুদ্ধে দেবীদ্বারবাসীর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ‘যুদ্ধজয়ের নেশা’ দেবীদ্বারবাসীর মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান সেনাছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্ট সন্নিকটে থাকায় এ অঞ্চলের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অপর দিকে প্রায় একই ব্যবধানে ছিল ভারত সীমান্ত। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভারত সীমান্ত পারাপারে একমাত্র সহজ ও নিরাপদ এলাকা ছিল দেবীদ্বার। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিতে উপজেলার ফতেহাবাদ গ্রামের জমাদ্দার বাড়ি সংলগ্ন ‘নলআরা’ (গভীর জঙ্গল) এবং প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর একমাত্র জিবীত সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ’র নিজ বাড়ি এলাহাবাদ গ্রামে দু’টি অস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি শুভপুর গ্রামেও একটি স্যাটেলাইট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। এখানে প্রাথমিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণসহ যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হতো। মুক্তিযোদ্ধাও এ অঞ্চলে অনেক বেশি। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাই প্রথম হলেও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেবীদ্বার। বিগত আ’লীগ সরকারের আমলে ‘নলআরা’ (গভীর জঙ্গল)’র অস্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে একটি স্মৃতিফলক এবং এলাহাবাদ গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ’ নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ করা হয়।
আলোচকরা আরো বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব’র উদ্যোগে ৪ ডিসেম্বর দেবীদ্বার হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নানা আয়োজনে পালন শুরু করে। দিবসটি সার্বজনীন করে তুলতে ১৯৯১ সাল থেকে প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নিয়ে দিবসটি পালন শুরু হলেও সে দায়িত্ব থেকে কোনভাবেই দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব মুক্ত হতে পারেনি। ২০১৬ সালের বিজয় দিবস উদযাপন প্রস্তুতি সভায় উপজেলা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ‘দেবীদ্বার মুক্ত দিবস পালনের উদ্যোগ উপজেলা প্রশাসন কিংবা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি জানালেও চলতি বছর একই পরিস্থিতি বিরাজ করে, তাই দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাব একাই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র চাকমার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে দিবসটি উপজেলা প্রেসক্লাব ও প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় একটি অশুভ শক্তির প্রভাবে বিপত্তি ঘটায় উপজেলা প্রশাসনকে আলাদারেখে উপজেলা প্রেসক্লাবের উদ্যোগে প্রেসক্লাব কার্যালয়ে ন্যাপ, সিপিবি, কৃষক সমিতি, ক্ষেত মজুর সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ’র নেতা-কর্মী ও সর্বসাধারণকে নিয়ে পালন করা হয়। তাই আলোচকরা দাবী করেন, আগামী বছরগুলোতে ‘৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত দিবস’টি উপজেলা প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে করার জোর দাবি জানান।
স্মৃতিচারনে আলোচকরা আরো বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র ৫দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পায়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি ময়নামতি ক্যান্টনম্যানে পায়ে হেঁটে আসা পথভোলা ১৪ পাকিস্তানি সেনার সাথে ভিংলাবাড়ি থেকে জায়রগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধে ১৪ জনের পুরো পাকিস্তানে সেনার দলটিকে ৩১ মার্চ ভোর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ হত্যা করতে ৩৩ বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন। ওই যুদ্ধে দেবীদ্বার থানার অস্ত্রাগার লুন্ঠন, মরিচের গুড়া নামক বঙ্গজ অস্ত্রটি ব্যবহার হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩৩ দানের মধ্যদিয়ে ১৪ পাকিস্তানি সেনার একটি দলকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনার গৌরব একমাত্র দেবীদ্বারেই প্রথম ছিল। এ তাছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে সম্মুখসমরেও পিছিয়ে ছিলনা এ অঞ্চল। বরকামতা যুদ্ধে শত্রæ সেনা হত্যা, ভানী এলাকার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরনে ৭ শত্রæ সেনা নিহত, বারুর যুদ্ধে ৭ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ, মহেশপুর, ধামতী-মাশিকাড়া ও ভূষণা পাকিস্তান হায়ানাদের হত্যাযজ্ঞে অন্তত: অর্ধশতাধিক নিরীহ জনতা শহীদ হওয়া সহ শত শত বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ লুটপাটের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। দেবীদ্বারের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান সৃষ্টিকারী প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর একমাত্র জীবিত সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড আব্দুল হাফেজ, যুদ্ধকালে ভারতের পালাটোনা ক্যাম্প প্রধান সাবেক সাংসদ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমএনএ আব্দুল আজিজ খান, আজগর হোসেন মাষ্টারসহ অসংখ্য যোদ্ধা অবদান রেখেছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের রক্তেঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবীদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ওই দিন হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন পরিচালনা করে। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়া হয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল আর, ডি হিরার নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং -ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা হয়ে দেবীদ্বারে আসে। হানাদাররা ওই রাতেই দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রæপ দেবীদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবীদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনিময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ সেনা সদস্য নিহত হয়। পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে পালিয়ে ময়নামতি ক্যান্টনম্যান্টে চলে যাওয়ার সংবাদে ৪ ডিসেম্বর ভোর থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রæপগুলো এবং হাজার হাজার জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে উপজেলা সদর অভিমুখে আসতে থাকে এবং ‘জয়বাংলা” শ্লোগানে বিজয়ের উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *